মঙ্গলবার, ০৬ মে ২০২৫, ০৫:৫৫ পূর্বাহ্ন
মোঃ মাইন উদ্দিন : বাংলাদেশের বাউলদের মধ্যে শৈশবে যার গান আমার সব থেকে ভালো গালতো, যার সুর শুনলে মন ভরে উঠতো তাদের মধ্যে কোকিল কণ্ঠের অধিকারী বাউল শিল্পী টোকের ফজলুল হোক ছিলেন অন্যতম। তিনি যেমন ছিলেন কোকিল কণ্ঠের অধিকারী তেমনি “কোকিল থাকো তুমি বনে নিশিতে আসিও রে কোকিল আছে কথা গোপনে রে উড়ে যাও বনের কোকিল রে” এ গানটি গেয়ে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
বাউল শিল্পী ফজলুল হোক ১৯৫৪ সালে গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার টোক নামক এলাকার সুলতানপুর গ্রামের স্বনামধন্য তালুকদার পরিবারে জন্মগ্রহন করে পিতা মরহুম মোহাম্মদ আব্দুস সামাদ তালুকদারের আদর স্নেহে হাটি হাটি পা পা করে বড় হয়ে এক নন্দিত বাউল শিল্পী হয়। পরে ২০১৪ সালের ১৪ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আমার যতটা মনে আছে, আশির দশকে গাজীপুর, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ জেলায় বাউল শিল্পী বা বাউল গানের কথা ভাবলে প্রথমেই সবার মুখে চলে আসতো বাউল ফজলুল হোকের নাম। অর্থাৎ যে বাউল গানের অনুষ্ঠানে ফজলুল হোক নেই সে অনুষ্ঠানে শ্রুতা থাকতো কম। আর যেই অনুষ্ঠানে ফজলুল হোক থাকতেন এ অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের ঢল নামতো। আমাদের দেশের বাউল ও বাউল গানকে যদি আমরা কোন ভাবে আলাদা করতে চাই তবে অনায়েসে দু’ভাগে বিভক্ত করা যাবে। যেমন: একদল বাউল শুধু দেহতত্ত্ব আর মানব ধর্ম নিয়ে গান গায়। যাদের গানে আমরা মানব সেবা আর নিজেকে অন্যের তরে বিলিয়ে দেয়ার কথাই শুনতে পাই। আরেক দল দেহতত্ত্বের পাশাপাশি ভাবের গান, প্রেমের গান গায়। যে গানে থাকে বিরহ বেদনা। তবে এ ক্ষেত্রে বাউল ফজলুল হোক ছিলেন দ্বিতীয় ধারার। তার গানে থাকতো প্রেম, বিরহ, বেদনা ও হাসি-কান্না। তার গানের কথা, সুর খুব সহজেই মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করতো। মানুষও তার গানে নিজেদের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেতো। এছাড়াও ফজলুল হোক বাউল ছিলেন গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বাউল। তার গান গ্রামের সাধারণ কৃষক, শ্রমিক থেকে শুরু করে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মনের খোরাক যুগিয়ে আনন্দ দিয়েছে। তিনি নিজেও অনেকগুলো বিচ্ছেদ গান লিখেছেন। তার লেখা বিচ্ছেদ গানগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় হলো, “কোকিল থাকো তুমি বনে”, “তাল গাছেরই আগায় বাবুই বানাইছে কোন বাসা”, “আমি বলি না কারো সনে রে, যে দুঃখ অন্তরে রে আমার, যে দুঃখ অন্তরে।” তার লেখা উল্লেখিত এই গানগুলো আমি আশির দশকে বাউল ফজলুল হোকের কণ্ঠে প্রথম শুনেছিলাম কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার সালুয়া ইউনিয়নের চরকালপুর গ্রামে টুলি মৌলবীর বাড়িতে। সময়টা সম্ভবত ১৯৮৬/ ৮৭ সালের দিকে। সেসময়টা ছিল টেপরেকর্ডের যোগ। তখন আমার চাচাত ভাই মরহুম ফজলুর রহমান ফুল মিয়া ভাইয়ের একটা টেপরেকর্ডার ছিল আর এ টেপরেকর্ডার দিয়ে গান রেকর্ড করতে গিয়েই বাউল ফজলুল হোকের সাথে পরিচয় হয়। তারপর আমার চাচাতো ভাইয়ের নাম ফজলুর রহমান হওয়ায় বাউল ফজলুল হোকের সাথে গড়ে উঠে তার বন্ধুত্বের সম্পর্ক। পরে এ বন্ধুত্বের সুবাদে বাউল ফজলুল হোক আমাদের বাড়িতে একাধিকবার বেড়াতে আসে এবং আমরা ঘরোয়া পরিবেশে তার বিচ্ছেদ গান রেকর্ডিং করি। এরপর থেকে বাউল ফজলুল হোককে আমি বড় ভাইয়ের মতই শ্রদ্ধা করেছি। আজ আর সেই কেকিল কণ্ঠের অধিকারী বাউল ফজলুল হোক নেই। নেই তার সেই কোকিলের মতো সুর, আমরা তাকে ভুলে গিয়েছি। ভুলে গিয়েছি তার জাদু মাখা বেহালার কথা, বেহালার সুরের কথা। যে বেহালা তার কথা শুনতো। বলতে গেলে তিনি এতো সুন্দর বেহালা বাজাতেন, তার মতো করে আর কোনো বাউলকে বেহালা বাজাতে দেখিনি আমার জীবনে। প্রিয় বাউল শিল্পী ফজলুল হোকের সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল ২০১২ সালের দিকে কটিয়াদি বাজারে। তার সাথে আমার এ দেখাই ছিল শেষ দেখা এবং শেষ চা আড্ডা। এর দু’বছর পর ২০১৪ সালে তিনি মৃত্যু রবণ করেন।
পরের বিষয়টা না বললেই নয়, প্রযুক্তির কল্যাণে কিছুদিন আগে হঠাৎ অনলাইনে পরিচয় হয় বাউল শিল্পী ফজলুল হোক এর ছেলের সাথে। ছেলের নাম আবুল কালাম আজাদ। তিনিও বর্তমনে বাউল শিল্পী। গানের জগতে তার নাম কালাম সরকার। কালাম সরকারের সাথে পরিচয় হওয়ার পর একদিন তাকে কুলিয়ারচর উপজেলার ফরিদপুর ইউনিয়ন আবদুল হামিদ ভূঞা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে গানের গাওয়ার জন্য এনে ছিলাম। ঐদিন তার সাথে বিশিষ্ট বাউল শিল্পী মরহুম আবেদ আলীর ছোট ছেলে বাউল শিল্পী লিটন সরকারও ছিলেন। কালাম সরকার সেদিন খুব ভালো গান গেয়েছেন। তবে এলাকার মুরব্বিদের অনুরোধে তার পিতা মরহুম ফজলুল হোকের গাওয়া গানগুলো অত্যন্ত সুন্দর গেয়েছেন। বলতে গেলে তার পিতার মতই। সেই হিসেবে আমি বাউল শিল্পী কালাম সরকারের শিল্পী জীবনের সফলতা কামনার পাশাপাশি তার পিতা মরহুম ফজলুল হোক বাউলের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।